বাংলাদেশে ট্রাম্প সমর্থকদের দমন করা হচ্ছে দাবি করে ইন্ডিয়া টুডে’র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর

 বাংলাদেশে ট্রাম্প সমর্থকদের দমন করা হচ্ছে দাবি করে ইন্ডিয়া টুডে’র উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় উদযাপনকারী সমর্থকদের উপর দমন পীড়ন চালানো হচ্ছে বলে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় টিভি চ্যানেল ইন্ডিয়া টুডে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয় ট্রাম্পকে সমর্থন করার অপরাধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থকদের উপর রেইড দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করেছে এবং পুলিশ ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে তৈরি করা ব্যানার ও পোস্টার জব্দ করেছে।

ফ্যাক্টচেকিংয়ের সংজ্ঞামতে প্রতিবেদনটি ডিসিইনফরমেশন তথা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা খবর ও মিসলিডিং তথা বিভ্রান্তিকর খবরের আওতায় পড়ে। আন্তর্জাতিক ও বাংলাদেশি মূলধারার সুপরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলো তাদের খবরে (, , ) জানাচ্ছে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং তারা দলীয় সমাবেশে যোগ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

ইন্ডিয়া টুডে তাদের ভিডিও প্রতিবেদনের পাশাপাশি অনলাইন পোর্টালেও একটি পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে কোন সূত্র ছাড়াই দাবি করা হয় ”ইন্ডিয়া টুডে জানতে পেরেছে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নন বরং সাধারণ নাগরিক।” এক্ষেত্রে গ্রেফতারকারী কতৃপক্ষের কোন বক্তব্যও নেয়া হয়নি। খবরটিকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যাতে মনে হয় কেবলমাত্র ট্রাম্প সমর্থক হওয়ার কারণে এবং ট্রাম্পের বিজয় উদযাপন করার অপরাধেই তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

অথচ চ্যানেলটির ওয়েব পোর্টালে ব্যবহৃত ভিডিওতেই দেখা যাচ্ছে আটকৃতদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমান ও নব্বইয়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিহত যুবলীগ কর্মী নুর হোসেনের ছবি রয়েছে।

ফ্রান্স ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম এএফপি’র করা এক প্রতিবেদন (এএফপি থেকে প্রকাশ করেছে ব্যারনস) থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশে ট্রাম্পের ছবিসহ ১০ ব্যাক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে যারা পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমর্থক। প্রতিবেদনে পুলিশের বরাতে বলা হয় ফাঁস হওয়া এক ফোনালাপে হাসিনা তার দলের নেতাকর্মীদের ১০ নভেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করার নির্দেনা দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা ও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্র্রাম্পের ছবি সাথে রাখতে বলেন। ওয়াশিংটনের সাথে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্পর্ক নষ্ট করার জন্যই হাসিনা এই নির্দেশনা দেন বলে দাবি করে পুলিশ।

গত ৮ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনার একটি ফাঁসকৃত ফোনালাপ ছড়িয়ে পড়ে। ফাঁস হওয়া ফোনালাপটি হাসিনারই বলে স্বাধীনভাবে যাচাই করে জানিয়েছে দ্য প্রিন্ট। এর একটি ট্রান্সক্রাইভড ভার্সন প্রকাশ করেছে জাস্টনিউজবিডি ডটকম। এতে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ১০ নভেম্বর নূর হোসেন দিবসে ঢাকায় ট্রাম্পের ছবিসহ সমাবেশ করতে হবে। যাতে করে কেউ মিছিলে হামলা করলে সেটাকে ট্রাম্পের ছবির উপর হামলা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। হাসিনাকে বলতে শোনা যায়, ট্রাম্পের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে। এমন কিছু হলে হামলার ছবি-ভিডিও ট্রাম্পের কাছে পাঠানো হবে।

ইন্ডিয়া টুডে’র ভিডিও প্রতিবেদনে চ্যানেলটির উপস্থাপিকা আশুতোষ মিশ্র নামের একজন প্রতিবেদককে কথিত ট্রাম্প সমর্থকদের গ্রেফতারের ঘটনা কী বার্তা বহন করে তা বিশ্লেষণ করতে বলেন। আশুতোষ তার বিশ্লেষণে বলেন, এটা খুবই অদ্ভুত এবং হাস্যকরও। এটা এই পরিষ্কার বার্তা দেয় যে বাংলাদেশ সরকার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় না। এবং এটা এমন সময়ে ঘটলো যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশে হিন্দু ও খ্রিস্টানসহ সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন।”

”ট্রাম্প সমর্থকদের গ্রেপ্তার ও ব্যানার, পোস্টার জব্দ করা এই বার্তা দেয় যে বাংলাদেশ সরকার এগুলো সহ্য করবেনা। এটা ট্রাম্পের অন্য সমর্থকদেরও এই বার্তা দেয় যে তারা যদি ট্রাম্পকে সমর্থন জানাতে এগুলা করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও একই রকম পদক্ষেপ নেয়া হবে” বলেন মিশ্র।

দেখা যাচ্ছে ফাঁস হওয়া ফোনালাপে শেখ হাসিনা তার নেতাকর্মীদের উপর হামলা হলে সেটিকে ট্রাম্পের ছবির উপর হামলা হিসেবে উপস্থাপনের যে পরিকল্পনার কথা বলছিলেন, ইন্ডিয়া টুডে’র প্রতিবেদন সে উদ্দেশ্যই সাধন করছে।

ইন্ডিয়া টুডে টিভি টুডে নেটওয়ার্ক লিমিটেডের মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন আরেকটি চ্যানেল হলো Aaj Tak। চ্যানেলটিও তাদের পোর্টালে ইন্ডিয়া টুডের মত করে খবর প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশে ট্রাম্প সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। স্বীকৃত ফ্যাক্টচেক প্লাটফর্ম mediabiasfactcheck.com এর বিশ্লেষণ মতে ইন্ডিয়া টুডে একটি মধ্য ডানপন্থী সংবাদমাধ্যম। যা খুবই কদাচিৎ নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা খবর প্রকাশের এটিই প্রথম ঘটনা নয়। গত ৫ আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, ড.ইউনুস, বাংলাদেশ সেনবাহিনী, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ, বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও ইসলামপন্থীদের উত্থান  নিয়ে অব্যাহতভাবে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা খবর প্রকাশ করে চলেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। এতে ভূঁইফোড় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি মূলধারার পেশাদার সংবাদমাধ্যমগুলোও বাদ যাচ্ছে না। ভারতীয় গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর ও অপতথ্যমূলক খবর প্রকাশ করা নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন দেখুন এখানে- , , , ,