বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর ‘গণহত্যা’ চালানোর যে দাবি করা হচ্ছে সেটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অংশ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক জন ড্যানিলোভিজ। নিজের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডেলে এক পোস্টে এই মন্তব্য করেন তিনি।
২০০৭ সাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৪ সালে ঢাকা ছাড়ার আগে তিনি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চীফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ড্যানিলোভিজ তার পোস্টে লেখেন, “বাংলাদেশ নিয়ে হিন্দুত্ববাদী লবিংয়ের সবচেয়ে চাতুরিপূর্ণ দিক হচ্ছে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা এর উদ্দেশ্য নয়। এটা স্পষ্ট যে হিন্দুদের উপর “গণহত্যা” চালানোর যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বেকায়দা ফেলার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর তৎপরতার অংশ।”
আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনাকে আবার ক্ষমতায় বসানোর জন্যই এই তৎপরতা চালানো হচ্ছে দাবি করে তিনি লেখেন, “এই তৎপরতার উদ্দেশ্য হচ্ছে আওয়ামীলীগ ও শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসন করা যাতে করে তারা আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারে। হাসিনাকে তারা আবার ফিরিয়ে আনতে চায় কেন? এর উত্তর সহজ। বাংলাদেশি জনগণের উপর তাদের এই আস্থা নেই যে বাংলাদেশিরা নিজেরাই নিজেদের নেতা নির্বাচন করুক। বরং তারা এমন একটা সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে চায় যারা ইন্ডিয়ার স্বার্থ রক্ষা করবে।”
“হিন্দুত্ববাদী আক্রমণের আরেকটা প্রধান দিক হচ্ছে যারাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন করবে এবং ইতিপূর্বে যারা হাসিনার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে তাদেরকে ইসলামিস্ট হিসেবে সাব্যস্ত করা। এটা একটা বিদ্রুপাত্মক ব্যাপার যে যারা ধর্মীয় সহিষ্ণুতার কথা বলছে তারা নিজেরাই উগ্র ধর্মান্ধ।” -দাবি করেন ড্যানিলোভিজ।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন আইডি থেকে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর গণহত্যা চালানো হচ্ছে, মন্দির ভেঙ্গে দেয়া হচ্ছে বলে অব্যাহত প্রচারণা চালানো হয়েছে। ভারতসহ পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদ সমাবেশ থেকেও একই দাবি করা হয়েছে।
গত ১৭ সেপ্টেম্বর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ তাদের এক প্রতিবেদনে দাবি করে সাম্প্রদায়িক হামলায় ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট সময়কালের মধ্যে ৯ জন হিন্দু ধর্মালম্বী হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে নেত্র নিউজ তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখিয়েছে এই ৯ ব্যাক্তির মধ্যে একজনও সাম্প্রদায়িক হামলায় নিহত হননি। এদের একটা বড় অংশ আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন। নিহতদের কেউ কেউ এমনকি সরকার বিরোধী আন্দোলনকারীদের উপর হামলায়ও অংশ নিয়েছেন। নেত্র নিউজ দেখিয়েছে এই ৯ জনের মধ্যে একজন এমন রয়েছেন যিনি মূলত স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে সাম্প্রদায়িক হামলা ও মন্দির ভাঙ্গচুরের অধিকাংশ অভিযোগই ছিলো মূলত মিথ্যা ও গুজব এবং উগ্রবাদী হিন্দুরা এসব গুজব ছড়ানোর সাথে জড়িত। ফ্যাক্ট চেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার ”বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক্সে সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের ভয়াবহতা” শিরোনামে করা এক প্রতিবেদনে দেখিয়েছে কিভাবে ভারত থেকে পরিচালিত বিভিন্ন এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলার ভুয়া তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। আর অপতথ্য ছড়ানোতে দায়িত্বশীল ব্যাক্তিবর্গ এমনকি কয়েকটি মূলধারার মিডিয়াও যোগ দিয়েছে।
আরেকটি ফ্যাক্টচেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব ”বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে ভারতে যেসব অপতথ্য ছড়ালো” শিরোনামে তাদের এক প্রতিবেদনে এমন অনেকগুলো গুজব শনাক্ত করেছে যেগুলোতে ভিন্ন ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হামলা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে।
বিবিসি বলছে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর হিন্দুদের মন্দির রক্ষায় মুসলিম তরুণরা সারাদেশে রাত জেগে মন্দির পাহারা দিয়েছে।