ফ্রান্স ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা এএফপি’র করা এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে শত শত মন্তব্য প্রতিবেদন লিখছে ভুয়া বিশেষজ্ঞরা। এসব ভাড়াটে লেখকদের পরিচয় বিবরণীতে বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা সংস্থার সাথে কাজ করার কথা উল্লেখ থাকলেও এএফপি’র অনুসন্ধান থেকে জানা যাচ্ছে বাস্তবে এসব নামে কারো অস্তিত্বই নাই।
এরকমই একজন অস্তিত্বহীন লেখক ডরিন চৌধুরী। দেশের প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার, ঢাকা ট্রিবিউন, নিউ এইজ এই অস্তিত্বহীন লেখকের একাধিক লেখা প্রকাশ করেছে। ডেইলি স্টারের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে দৈনিকটি ডরিন চৌধুরী নামে অন্তত টি লেখা প্রকাশ করেছে। বর্তমানে লেখাগুলো আর ওয়েবসাইটে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লেখাগুলোর শিরোনাম ছিল যথাক্রমে “What are US-Bangladesh relations like, post sanctions?”, “What Donald Lu’s visit means for Bangladesh”, Understanding the proposed Bangladesh-India Comprehensive Economic Partnership Agreement” এবং “The world must not turn away from the Rohingya plight.”
ঢাকা ট্রিবিউনে এই নামে দুটি কলাম ছাপিয়েছে এবং তার লেখার উদ্ধৃতি ব্যবহার করে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (CEPA) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যেগুলো এখনও পত্রিকাটির ওবেসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া ইংরেজি দৈনিক নিউএইজ-এর ওয়েবসাইটে ৫টি ও ডেইলি এশিয়ান এইজের ওয়েবসাইটে ৪টি, বাংলাদেশ পোস্টের ওয়েবসাইটে ১টি লেখা পাওয়া যাচ্ছে।
ডরিন চৌধুরীর লেখক প্রোফাইলে পত্রিকাগুলোতে যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে তা মূলত পশ্চিমবঙ্গের একজন ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারের। লেখক পরিচিতিতে তাকে নেদারল্যান্ডসের গরিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরাল রিসার্চার বলা হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি এএফপিকে জানিয়েছে এ নামে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষক-শিক্ষার্থী নেই।
শুধু দেশীয় গণমাধ্যমে নয়, বিদেশি বহুল পরিচিত ও অখ্যাত গণমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ নিয়ে এই অস্তিত্বহীন লেখকের লেখা। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক eurasiareview.com প্রকাশ করেছে ৯টি, asiatimes.com প্রকাশ করেছে ২টি, moderndiplomacy.eu ও thegeopolitics.com ১১টি করে লেখা প্রকাশ করেছে।
এই ভুতুড়ে লেখকের লেখার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে বাংলাদেশ বিষয়ক লেখাগুলো মূলত সরকারের নানা উন্নয়নমূলক পদক্ষেপের প্রশংসা করছে, পদ্মা সেতু কিভাবে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, বাহিনী হিসেবে র্যাবের প্রশংসা, ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণের অন্ধকার দিক তুলে ধরা, বাংলাদেশ-চায়না সম্পর্কের ইতিবাচক দিক, যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের অকার্যকারিতা, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রিপোর্টের অসারতা, যুক্তরাষ্টে্রর বন্দুকধারীর হামলা, বর্ণবাদ ইত্যাদি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
এরকমই আরেকজন লেখক ফুমিকো ইয়ামাদা। তার লেখক পরিচিতিতে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ণ ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দাবি করা হয়েছে। তবে এএফপির অনুসন্ধানে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এ নামে কোন গবেষক নেই এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে কোন কিছুও সেখানে নেই। southasiajournal.net এ তার ১১ টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই পোর্টালে প্রকাশিত একটি লেখা “জাপান, ভারত, বাংলাদেশ: আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য বার্তা” শিরোনামে অনুবাদ করে ছেপেছে বাংলা দৈনিক মানবজমিন। ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন তারও ২টি লেখা ছাপিয়েছে। thegeopolitics.com ও তার একটি লেখা প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই বাংলাদেশ বিষয়ক।
এমনই একজন ভুয়া গবেষক এমিলিয়া ফার্ন্দান্দেজ যার কথা উঠে এসেছে সামাজিক মাধ্যমে। তার পরিচয় হিসেবে বলা হচ্ছে তিনি সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পিএইচডি গবেষক। পলিসি ওয়াচারে প্রকাশিত তার এক নিবন্ধের বরাত দিয়ে “বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেসস্টাডি” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন করেছে বাংলা দৈনিক সমকাল। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা গেছে পলিসি ওয়াচারে লেখকের যে ছবি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি ভুয়া। ই-কমার্স সাইট থেকে ডাউনলোড করা হয়েছে ছবিটি। এছাড়া যোগাযোগ করলে সুইজারল্যান্ডের লুসার্ন বিশ্ববিদ্যালয় জানায় এ নামে তাদের কোন পিএইচডি গবেষক নেই।