সাবেক দুই মার্কিন কূটনীতিকের শাস্তি সংক্রান্ত খবরটির সুত্র কী?

 সাবেক দুই মার্কিন কূটনীতিকের শাস্তি সংক্রান্ত খবরটির সুত্র কী?

“শাস্তির মুখোমুখি বিএনপির দুই মার্কিন লবিস্ট” এমন শিরোনামে ৫ সেপ্টেম্বর আপলোড করা একটি ভিডিও প্রতিবেদন চোখে পড়ে ফেসবুকে Bangla News Point নামের একটি পেইজে। এতে বলা হয় মার্কিন আইন লঙ্ঘন করে বিএনপির পক্ষে লবিস্ট হিসেবে কাজ করায় আইনি গ্যাড়াকলে পড়েছেন সাবেক ‍দুই মার্কিন কূটনৈতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ডেনিলুয়িকজ। তবে প্রতিবেদনে তথ্যের উৎস সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ফেসবুকের সার্চ করে দেখা যায়, ৩১ আগস্ট থেকে ৬ সেপ্টেম্বর সময়ের মধ্যে বহু সংখ্যক আইডি ও পেইজ থেকে এমন দাবি করে বেশ কিছু পোস্ট করা হয়েছে।

মূলধারার খবরটির সুত্র

খবরটি কৌতুহল উদ্দীপক হওয়ায় এর নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করতে পেইজটির অন্যান্য কন্টেন্টগুলো বিশ্লেষণ করে দেখয়া হয়। এতে দেখা যায়, পেজটির অধিকাংশ কন্টেন্টই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি এবং সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডামূলক। পেজটির নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ হওয়ায় গুগলে কী ওয়ার্ড সার্চ করে দেখা হয়, মূলধারার গণমাধ্যমে এ নিয়ে কোন সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিনা। 

বাংলা সার্চে দেখা গেলো, কয়েকটি ভুঁইফোড় ও অখ্যাত অনলাইনের পাশাপাশি মূলধারার নিউজ টোয়েন্টিফোর টিভি তাদের অনলাইন ভার্সনে গত ৩১ আগস্ট সকাল ১১টা ২৩ মিনিটে খবরটি প্রকাশ করেছে। এছাড়া এ খবরটির উপর আলোকপাত করে দৈনিক সময়ের আলো পত্রিকায় গত ৫ সেপ্টেম্বর অনলাইন ও মূল পত্রিকা দুই ভার্সনেই  “বিএনপির লবিস্ট অপতৎপরতা” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাসের একটি মতামত কলাম। 

নিউজ টোয়েন্টিফোরের ২২ মিনিট আগে একই দিন সকাল ১১টা ০১ মিনিটে খবরটি প্রকাশ করেছে বাংলা ইনসাইডার নামে একটি অনলাইন পোর্টাল। ফলে অনুমান করা সহজ হয় যে বাংলা ইনসাইডার থেকে খবরটি নিয়েছে নিউজ টোয়েন্টিফোর। দু’টি প্রতিবেদনের মধ্যে তুলনা করে দেখা যায় কিছুটা সম্পাদনাসহ নিউজ টোয়েন্টিফোরের প্রতিবেদনটি বাংলা ইনসাইডারের প্রতিবেদনের অনুরূপ।

বাংলা ইনসাইডারকে অতীতে একাধিক স্বীকৃত পেশাদার ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান ভুয়া খবরের উৎস হিসেবে শনাক্ত করেছে। একাধিকবার এই পোর্টালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রকাশিত সূত্রবিহীন ভুয়া খবর মূলধারার গণমাধ্যম পুনরায় প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করেছে।

ইংরেজি খবরের সুত্র

এবার ইংরেজিতে খবরটির উৎস খুঁজে বের করতে গুগলে ইংরেজিতে কী ওয়ার্ড সার্চ করে Weekly Blitz Press Xpress নামক দু’টি পোর্টালে এ সম্পর্কে প্রতিবেদন পাওয়া গেলো। গত ১১ আগস্ট উইকলি ব্লিৎস-এর বিশেষ প্রতিনিধি তাজুল ইসলামের BNP lobbyists Milam and Danilowicz violate US law” শিরোনামে করা প্রতিবেদনে দাবি করা হয় সাবেক কূটনৈতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও ডেনিলুয়িকজ জাস্ট নিউজের মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাথে মিলে সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীর ছদ্মাবরণে বিএনপির পেইড এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। 

মূলত লবিস্ট হিসেবে নিজেদের নিবন্ধন ভুক্ত না করে লবিস্টের ভূমিকা পালন করায় তারা কিভাবে মার্কিন আইন লঙ্ঘন করছেন ও এর শাস্তি কী সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে। এছাড়া তারা বাংলাদেশে উগ্র ইসলামপন্থীদের পক্ষে ভূমিকা রাখছেন বলেও দাবি করা হয়েছে এতে। তবে তারা আইনের মুখোমুখি হয়েছেন বা শাস্তি পেতে যাচ্ছেন এমন কিছুই দাবি করা হয়নি উইকলি ব্লিটজের প্রতিবেদনে।

একইভাবে “Breaking the US Law: Two BNP Lobbyists Face Legal Backlash” শিরোনামে প্রেস এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে গত ১৫ আগস্ট। এতে শিরোনামেই দাবি করা হয় যে বিএনপির দুই লবিস্ট শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন। তবে খবরের মূল অংশে শাস্তি সংক্রান্ত কিছুই পাওয়া যায়নি। মূলত উইকলি ব্লিৎস-এর প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে প্রেস এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে এদিক সেদিক করে  প্রায় একই কথাই বলা হয়েছে। 

এবার প্রেস এক্সপ্রেসের ইংরেজি প্রতিবেদনের সাথে বাংলা ইনসাইডারের বাংলা প্রতিবেদনটি তুলনা করে দেখা যায় এটি প্রেস এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনের অবিকল বাংলা অনুবাদ। আর বাংলা ইনসাইডারের খবরই কিছুটা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছে নিউজ টোয়েন্টিফোর টিভি।

সুত্রহীন খবর যখন কলামে

এবার আসা যাক  অধ্যাপক মিল্টন বিশ্বাস-এর কলাম প্রসঙ্গে।  অধ্যাপক মিল্টনের কলামটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এটি মোট ১০টি প্যারাতে বিভক্ত। কলামের কন্টেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১০টির মধ্যে প্রথম ৭টি প্যারা উইকলি ব্লিৎসে যা বলা হয়েছে তাই প্রায় হুবহু উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্যারাগুলোর ক্রম এদিক সেদিক করে সাজানো হয়েছে। লেখার শুরুতেই অধ্যাপক মিল্টন দাবি করেছেন, “সম্প্রতি মার্কিন আইন ভঙ্গ করা দুই বিএনপি লবিস্টকে আইনের সম্মুখীন হতে হয়েছে।” তবে পুরো লেখায় কোথাও এ দাবির সূত্র সম্পর্কে কোন তথ্যসুত্র দেওয়া হয়নি। 

ফলে এটি প্রতীয়মান হয় যে, সূত্রহীন খবরটির ছড়িয়ে পড়ার মূল উৎস উইকলি ব্লিৎস পত্রিকা। যদিও এর প্রতিবেদনে উইলিয়াম মাইলাম বা ডেনিলুয়িকজ-এর শাস্তি বা আইনের মুখোমুখি হওয়ার কোন দাবি করা হয়নি। সুতরাং যথাযথ সুত্রহীন একটি খবর কয়েক হাত ঘুরে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি কলামেও চলে এসেছে।